নারী ও শিশু পাচার সমস্যা : বৈশ্বিক ও বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট
নারী ও শিশু পাচার একটি সংঘবদ্ধ অপরাধ। এটা এক ধরনের ব্যবসা
যাতে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী নিষ্পাপ, অসহায় ও নি:স্ব নারী, মেয়ে ও শিশুদের পণ্য হিসেবে
ব্যবহার করে। এ ধরণের ব্যবসা কোন একটি দেশের অভ্যন্তরেও হতে পারে, আবার দুটি দেশের
মধ্যেও সংঘটিত হতে পারে। পাচার একটি মারাত্মক বৈশ্বিক সমস্যা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপেক্ষাকৃত
দরিদ্র অঞ্চল বা দেশ থেকে অপেক্ষাকৃত ধনী অঞ্চল বা দেশে নারী ও শিশুদের পাচার করা হয়।
জাতিসংঘ নারী ও শিশু পাচারকে সংজ্ঞায়িত করেছে এভাবে “যে অবৈধ ও গুপ্ত প্রক্রিয়ায় অপরাধ
জগতের ব্যবসায়ীরা তাদের নিজেদের মুনাফা অর্জনের জন্য নারী ও শিশুদের যৌনবৃত্তি, দাসত্ব,
মিথ্যা বিয়ে, গোপন নিয়োগ ইত্যাদিতে বাধ্য করতে তাদেরকে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে স্থানান্তর
করে, তাই হল নারী ও শিশু পাচার।”
পাচারকারীরা সারা বিশ্বে অপরাধচক্র সৃষ্টির মাধ্যমে প্রতিবছর
বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার মুনাফা অর্জন করে। কিছু সমাজ বিজ্ঞানী বিশ্বাস করেন যে, এটি অস্ত্র
ও মাদক ব্যবসার পর বিশ্বের সবচেয়ে মুনাফা অর্জনকারী ব্যবসা।
নারী ও শিশু পাচারের প্রধান কারণসমূহ
প্রধানত দারিদ্র্যের কারণেই নিঃস্ব নারী ও শিশুরা জ্ঞাত
ও অজ্ঞাতসারে পাচারকারীদের শিকার হতে বাধ্য হয়। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা দারিদ্র্য ও অশিক্ষাকে
প্রধান দুটি কারণ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। অনেক নি:স্ব নারী ও শিশু বাংলাদেশের মতো দরিদ্র
দেশগুলোতে নিয়মিত খাদ্য ও আশ্রয়ের অনিশ্চয়তায় থাকে। এরা সহজেই অসাধু ব্যবসায়ীদের দ্বারা
প্রলোভিত হয়। যেহেতু নারীরাই দারিদ্র্যের দ্বারা বেশি আক্রান্ত হয়, তাই তাদের অভিপ্রায়ণ
(migration) ঘটে বেশি।
অনেকগুলো কারণে অসাধু ব্যবসায়ীরা পাচারে উৎসাহী হয়ে ওঠে।
তার একটি প্রধান কারণ হল যৌন ব্যবসা। বিশ্বে একটি সংগঠিত যৌন বাজার আছে। অন্যান্য কারণেও
এটা হয়ে থাকে; যেমন ছোট ছেলেদের উটের জকি হিসেবে ব্যবহারের জন্য, মেয়ে – নারীদেরকে
দাসত্ব ও অঙ্গ ব্যবসার জন্যও পাচার করা হয়। এসব পাচারকৃত নারী ও শিশুদেরকে প্রচুর মুনাফায়
বিক্রি করা হয়।
দারিদ্র্য ছাড়াও আরও কিছু কারণ রয়েছে যা নারী ও শিশু পাচারে
সাহায্য করে। রাজনৈতিক বিরোধ ও যুদ্ধের কারণে মানুষ দেশের সীমান্ত পার হয়ে প্রতিবেশী
দেশে আশ্রয় নেয় যা নারী ও শিশু পাচারকে উৎসাহিত করে। এ প্রসঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশ একটি
প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এ অঞ্চলে রাজনৈতিক ও সাম্পদায়িক দাঙ্গা চলছেই। এ অবস্থায় সুযোগ নিয়ে
পাচারকারীরা নি:স্ব নারী ও শিশুদের প্রলুব্ধ ও অপহরণ করে।
বিশ্বায়ন উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে এবং উন্নয়ন অবশেষে সমস্যার
সৃষ্টি করে। রাষ্ট্রগুলোর বর্ধিত সম্পদ পাচারকে উৎসাহিত করে। আধুনিক শিল্পোন্নত সমাজের
উচ্চ ও অতিরিক্ত বস্তুবাদিতা মানুষকে অর্থ ও যৌনতার প্রতি আকৃষ্ট করে তুলেছে। বর্তমান
সময়ে যৌন পর্যটনের ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে নারী ও শিশু পাচার বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বায়ন
মূলধনের অবাধ স্থানান্তর, প্রযুক্তি পারদর্শীও যৌন পর্যটকদের উৎসাহিত করছে। তথ্য প্রযুক্তি
বিশেষ করে ইন্টারনেট ও ওয়েবসাইটের অত্যধিক উন্নতি “যৌন বাজারজাতকরণ” এ নতুন নতুন সুযোগ
সৃষ্টি করছে। এটি হল বৈশ্বিক যৌন ব্যবসা। পাচার যদিও অবৈধ তবুও এটি নারীদের অভিপ্রায়ণের
(migration) উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাণিজ্যে উদারনীতি গ্রহণের পর যৌন পর্যটকরা সাধারণত
অর্থনৈতিকভাবে উন্নত অঞ্চল ( পশ্চিম ইউরোপ, স্ক্যানন্ডিনেভিয়ান দেশসমূহ, উত্তর আমেরিকা,
অস্ট্রেলিয়া, উপসাগরীয় দেশ) থেকে দরিদ্র অঞ্চলে ভ্রমণ করে থাকে। দরিদ্র দেশের ধনিক
শ্রেণীও যৌন পর্যটন উপভোগ করে। এ কারণে বাংলাদেশে, ভারত, নেপাল, শ্রীলংকা থেকে নারী
ও শিশুরা প্রতারিত ও অপহৃত হয়ে পাচার হয়ে যাচ্ছে অন্য দেশে।
বাংলাদেশ বিশ্বের দরিদ্রতম একটি দেশ। এটি মানব পাচারের
একটি প্রকৃষ্ট স্থান। UNICEF রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রতিবছর গড়ে প্রায় ১৫০০০ জন নারী ও
শিশু বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়। নিরাপত্তা বাহিনী পাচারকালীন অতি সামান্য অংশকে উদ্ধার
করতে পারে।
বাংলাদেশ থেকে সাধারণত স্থলপথে প্রথমে ভারতে এবং পরে পাকিস্তানে
ও মধ্যপ্রাচ্যে নারী ও শিশু পাচার করা হয়ে থাকে। ভারতে প্রায় পাঁচ লাখ নারী যৌন বৃত্তিতে
লিপ্ত। তাদের শতকরা ২৭ জন বাংলাদেশী। মুম্বাই ও দিল্লীর মোট যৌন কর্মীর ০.২% এবং ২.৬%
বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া নারী। এদের অধিকাংশই পাচারের শিকার। সার্ক রিপোর্ট অনুযায়ী,
গত ১০ বছরে প্রায় ২ লাখ নারী বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যে পাচার হয়েছে। পাচারকারীরা
এ কাজে ভারত ও পাকিস্তানকে পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহার করেছে।
বাংলাদেশে নারী ও শিশু পাচার রোধে আমাদের করণীয়
নারী ও শিশু পাচার হ্রাস করতে হলে তিনটি বিষয় বিবেচনা করতে
হবে:
১. নারী ও শিশু পাচার প্রতিরোধ।
২. দেশের অভ্যন্তরে ও অন্য দেশে পাচারকৃত ও নির্যাতিত নারী
শিশু উদ্ধার।
৩. উদ্ধারকৃত নারী ও শিশুদের পুনর্বাসন।
নারী ও শিশু পাচার প্রতিরোধ করতে হলে প্রথমে দেশের দারিদ্র্য
দূর করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। যতদিন পর্যন্ত দেশে অশিক্ষিত, নিঃস্ব ও অসহায়
নারী ও শিশু থাকবে ততদিন পর্যন্ত পাচারকারীরা তাদের এ অসহায় অবস্থার সুযোগ নেবে। পাশাপাশি
আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে কঠোর হাতে পাচার দমন করতে হবে।
পাচারকৃত নারী ও শিশু উদ্ধারে সফলতা আনতে হলে দুটি পৃথক
প্রক্রিয়া গ্রহণ করতে হবে। একটি হল যারা দেশের মধ্যে পাচার হয়েছেন অন্যটি যারা অন্য
দেশে পাচার হয়েছেন তাদের উদ্ধারের জন্য। প্রথম প্রক্রিয়ায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর
ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও নাগরিক সমাজ ও এনজিও গুলোও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে
পারে।
পাচারকৃত নারী ও শিশুদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা প্রাথমিকভাবে
রাষ্ট্রকে করতে হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আক্রান্তরাই নিন্দিত হয়। যকন একজন নারী পাচার
ও বাধ্য হয়ে্ যৌন বৃত্তিতে লিপ্ত হয় তকন সে সামাজিক মর্যাদা হারায়। যদি সে উদ্ধারও
হয় তথাপি পুরোপুরি পুনর্বাসিত হয় না।
তাদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা সহজ, কিন্তু তাদের
মানসিক দুর্দশা দূর করা সহজ না। এ ক্ষেত্রে পুনর্বাসন কেন্দ্রে দীর্ঘমেয়াদী মানসিক
চিকিৎসা প্রয়োজন। এজন্য, প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধাসম্পন্ন পর্যাপ্ত পুনর্বাসন কেন্দ্র
থাকা প্রয়োজন।
No comments:
Post a Comment
Please Comment here