মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা এবং অস্থিতিশীল মিয়ানমার - বাংলাদেশ সীমান্ত
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা সমস্যা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা ইত্যাদি
সমস্যার পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রধান দেশ বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর থেকেই প্রতিবেশী
রাষ্ট্র ভারতের সাথে বর্ডার সমস্যা, পুশইন ও পুশব্যাকের মত সমস্যায় জর্জরিত। ্মতাবস্থায়
উত্তর – পূর্বাঞ্চলীয় রাষ্ট্র মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের দীর্ঘদিন যাবত যে কলহ চলে
আসছে তা কেবল রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কারণেই।
বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্তের নিকটবর্তী আরাকান নামক এলাকা
থেকে এদের আগমন।
রোহিঙ্গাদের মোট জনগোষ্ঠী প্রায় ১.৫ মিলিয়ন। ১৯৬০ সালের শুরু থেকেই মিয়ানমার সরকার কৌশলগতভাবে সকল প্রকার উন্নয়ন মূলক ধারা থেকে রোহিঙ্গাদের বিচ্যুত করার পাশাপাশি তাদেরকে নাগরিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত করে। স্বাধীনতার পরবর্তী মিয়ানমার ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে, রোহিঙ্গাদের আলাদা গোত্র হিসেবে নিজেদের দাবি কেবল ১৯৪৮ – ৫৮ সালের গণতান্ত্রিক সরকার কর্তৃক মেনে নেয়া হয়। কিন্তু পরবর্তী কোন সরকারই তাদের পূর্ণ মর্যাদা প্রদান করেনি। এ অবস্থা আরও ভয়াবহ রূপ নেয় ১৯৬২ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর।
রোহিঙ্গাদের মোট জনগোষ্ঠী প্রায় ১.৫ মিলিয়ন। ১৯৬০ সালের শুরু থেকেই মিয়ানমার সরকার কৌশলগতভাবে সকল প্রকার উন্নয়ন মূলক ধারা থেকে রোহিঙ্গাদের বিচ্যুত করার পাশাপাশি তাদেরকে নাগরিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত করে। স্বাধীনতার পরবর্তী মিয়ানমার ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে, রোহিঙ্গাদের আলাদা গোত্র হিসেবে নিজেদের দাবি কেবল ১৯৪৮ – ৫৮ সালের গণতান্ত্রিক সরকার কর্তৃক মেনে নেয়া হয়। কিন্তু পরবর্তী কোন সরকারই তাদের পূর্ণ মর্যাদা প্রদান করেনি। এ অবস্থা আরও ভয়াবহ রূপ নেয় ১৯৬২ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর।
১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন যেটি এখনও চর্চা করা হয় তাতে
রোহিঙ্গাদের সকল প্রকার নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। অপারেশন নাগামিন (ড্রাগন
কিং) নামক এক সমীক্ষায় ১৯৭৭ সালে প্রায় সকল মিয়ানমার অধিবাসীদের রেজিস্ট্রেশন করা হয়
এবং তাদেরকে পরিচয়পত্র দেওয়া হয়, যেটি এক দশক অব্যাহত থাকে। এই অপারেশনের ফলে মিয়ানমারের
প্রায় সকল নাগরিককে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয় এবং সেই অনুযায়ী নাগরিক মর্যাদা দেওয়া হয়।
কিন্তু রোহিঙ্গাদেরকে এর কোন ভাগেই নেয়া হয় নি এবং তাদের মধ্য থেকে প্রায় ২৫০০০০ রোহিঙ্গাকে
জোরপূর্বক বাংলাদেশে প্রেরণ করা হয়। ১৯৭৮ সালের এই পুশইন বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী
সমস্যার সবচাইতে বড় পুশইন গুলোর মধ্যে একটা। এদের মধ্য থেকে ১০০০০ শরণার্থীকে ১৯৭৯
সালে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ওপর আরোপিত মিয়ানমার রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত
রোহিঙ্গাদের ওপর রাষ্ট্র কতৃক যে নিয়মাবলি আরোপিত রয়েছে
তা এসব বাস্তুহারা মানুষদের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ককে আরও তিক্ততার পর্যায়ে নিয়ে এসেছে।
রোহিঙ্গারা যে সকল বৈষম্যের শিকার সেগুলো অনেক ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘনেরও শামিল।
মুক্ত বিচরণে বাধা প্রদান: রোহিঙ্গাদের সকল প্রকার স্বাধীন
চলাচল একপ্রকার নিষিদ্ধ এবং ইয়াংগুন অথবা অন্য কোন বড় শহরে স্থানান্তর, অত:পর সেখানকার
শ্রমবাজারে রোহিঙ্গাদের প্রবেশ এক প্রকার বে-আইনী।
শিক্ষার ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা: রোহিঙ্গাদের উচ্চ শিক্ষা
নেয়া থেকে বিরত রাখা হয় যার ফলে ছোট খাট ব্যবসা করে অথবা মজদুরী করে তাদের জীবিকা নির্বাহ
করতে হয়। এদের মধ্যে অনেকে আবার পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে কিংবা মধ্যপ্রাচ্যে উন্নত জীবন
যাপনের আশায় পাড়ি জমায়।
জোরপূর্বক শ্রম: মিয়ানমার সেনা রোহিঙ্গাদেরকে শুষ্ক মৌসুমে
জোরপূর্বক কাজ করায়। UNHCR তাদের কিছু নীতিমালার মাধ্যমে এই বলপূর্বক শ্রম আদায়ের সময়সীমা
আগের থেকে কমিয়ে নিয়ে এসেছে পূর্বে যা ছিল দৈনিক ১০ – ১২ ঘন্টা।
নিজের দেশে এ সকল বৈষম্যের শিকার রোহিঙ্গারা মিয়ানমার সরকারের
কাছে চরমভাবে নির্যাতিত।
রোহিঙ্গা শরণার্থীরা তাদের নিজ রাষ্ট্র মিয়ানমার এর প্রতি
সকল আস্থা হারিয়ে ফেলার দরুন এবং বাংলাদেশ কর্তৃক বিতাড়িত হওয়ার কারণে উভয় রাষ্ট্রের
প্রতিই আর তাদের কোন কর্তব্য থাকে না, কেবল তাদের নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাটাই
তখন সবচাইতে বড় ইস্যু হিসেবে আবির্ভূত হয়। সুতরাং আবির্ভাব ঘটে বিদ্রোহী সংস্থা ও মিলিশিয়াদের। এ ধরণের জঙ্গি সংগঠন
গুলোর মধ্যে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন ও আরাকান রোহিঙ্গা ইসলামিক ফ্রন্ট এর
নাম উল্লেখযোগ্য। প্রথমদিকে মিয়ানমারে এদের বিস্তার ও কার্যক্রম একপ্রকার নিষিদ্ধ ছিল,
কিন্তু প্রতিনিয়ত মিয়ানমার সরকারের অবহেলার স্বীকার হয়ে এবং বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক
বিতাড়িত হওয়ার ফলে তারা তাদের সংগঠন আরো মজবুত ও সুসংহত করতে সক্ষম হয়। পরবর্তীতে তারা
তাদের কার্যক্রম বাংলাদেশ পর্যন্ত প্রসারিত করে। কিন্তু মুখ্য বিষয় হল বাংলাদেশের যেসব
ইসলামী সংগঠন রয়েছে তারা এখন জঙ্গি সংগঠনগুলোকে টাকা, অস্ত্র, জনবল দিয়ে সাহায্য করে
আসছে।
পরিস্থিতি এ রকম ভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশ – মিয়ানমার সম্পর্কের আশঙ্কাজনক অবনতি
ঘটবে ভবিষ্যতে।
দুই ধরণের আশঙ্কা করা হচ্ছে এখানে। প্রথমত, এ জঙ্গি সংগঠনগুলো
অপেক্ষাকৃত বড় ও মাঝারি মানের সব ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করে। সুতরাং অস্ত্রের ব্যবহার
ও চোরাচালান বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা। দ্বিতীয়ত, জীবণু অস্ত্রের ব্যবহার পরিলক্ষিত হতে
পারে।
মিয়ানমার – বাংলাদেশ সীমান্ত ও রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যার
এ হাল থাকলে ভবিষ্যতে এ দু দেশের মধ্যে সম্পর্কের ভয়াবহ অবনতি ঘটতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের
ধারণা।
বাংলাদেশে – মিয়ানমার সম্পর্ক ও রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যার সমাধানকল্পে আমাদের করণীয়
প্রথমত, মিয়ানমারে নাগরিকত্ব আইন পুনর্বিবেচনার মাধ্যমে
বাস্তুহারাদের অন্তত কাজ করার অনুমতি দেওয়া যেতে পারে এবং বাংলাদেশ – মিয়ানমার সীমান্তবর্তী
এলাকাগুলোকে বিশেষ কার্যক্রমের আওতাধীন করা উচিত।
দ্বিতীয়ত, সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোর উন্নয়ন এবং এসকল এলাকার
গুলোর উন্নয়নকল্পে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনগুলোর হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত এবং সেই
কল্পে দু দেশের দ্বি-পাক্ষিক আলোচনার আবশ্যকতা রয়েছে।
তৃতীয়ত, এ সকল রোহিঙ্গা শরণার্থীর জন্য সাধারণ একটি শিক্ষানীতি
প্রণয়ন করা উচিত যেখানে দুটো বা তার চেয়েও বেশি ভাষা অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এ
লক্ষ্যে গৃহীত যে কোন দৃঢ় পদক্ষেপই ভবিষ্যতে রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা সমাধানে অগ্রণী
ভূমিকা পালন করতে পারে।
কক্সবাজারে শরণার্থী শিবিরের বাইরে থাকা মিয়ানমারের প্রায়
তিন লাখ নাগরিককে (রোহিঙ্গা) শরণার্থীর মর্যাদা দিতে বাংলাদেশের ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছে দাতা দেশ ও সংস্থা। তবে শিবিরের
বাইরে থাকা রোহিঙ্গাদের শরণার্থীর মর্যাদা দিলে আগামী একবছরে এর সংখ্যা চার গুন ছাড়িয়ে
যাবে। বর্তমানে কক্সবাজারের কুতুপালং ও নেয়াপাড়ার দুটি শিবিরে থাকা প্রায় ২৮ হাজার
রোহিঙ্গার শরণার্থীর মর্যাদা রয়েছে। এ দুই
শিবিরের বাইরে কক্সবাজারে আরও প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে।
দাতাসংস্থাগুলো চাইছে
শিবিরের বাইরে থাকা মিয়ানমারের নাগরিকরাও শরণার্থীর মতো একই সুবিধা নিয়ে বাংলাদেশে
অবস্থান করুক। বিষয়টি নিয়ে তারা বেশ স্পষ্ট মতামত প্রকাশের পাশাপাশি বিশেষ উন্নয়ন প্রকল্প
নেওয়ার তাগিদ দিচ্ছে। এমডিজি অর্জনে সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা উপজেলার তালিকায় আছে কক্সবাজারের
উখিয়া ও টেকনাফ। রোহিঙ্গাদের জন্য বিশেষ উন্নয়ন মূলক প্রকল্প নিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রায়
৩০ মিলিয়ন ইউরো দেয়ার প্রস্তাব করে। এতে সাড়া না পেয়ে একই ধরণের প্রস্তাব দেয় জাতিসংঘ।
সরকার এ মুহূর্তে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে মিয়ানমার কে রাজি করানোর উপর বেশি গুরুত্ব
দিচ্ছে। বিশেষ করে প্রায় ২৮ হাজার রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা
চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মিয়ানমারের পক্ষ থেকে কোন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। তাই কোন উন্নয়ন
মূলক প্রকল্প হাতে নিলে মিয়ানমারের নাগরিকরা এদেশে প্রবেশে উৎসাহিত হবে যেটা সরকার
চায় না।
No comments:
Post a Comment
Please Comment here